সুস্বাদু ড্রাগন ফল বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। চিকিৎসকেরা ড্রাগন ফলকে ‘ট্রপিক্যাল সুপারফুড’ বলছেন। ড্রাগন ফলের উপকারিতা বেশ চমকে ওঠার মতো। পুষ্টিবিশারদরা জানিয়েছেন, ড্রাগন ফলে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন সি, ভিটামিন বি১, বি২, বি৩ থাকে। ফলে রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে কার্যকর। ফাইবারের পরিমাণ বেশি থাকায় এই ফল খাদ্য পরিপাকে সহায়তা করে। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। এই ফলে থাকা ক্যারোটিন, লাইকোপেন প্রস্টেট ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। এ কারণে ড্রাগন ফলকে সব রোগের মহৌষধ বলা হয়।
চিকিৎসকদের মতে, ড্রাগন ফলে প্রচুর অ্যান্টি অক্সিডেন্ট আছে। যা রক্তে অণুচক্রিকা বা প্লেটলেটের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। ফলে ডেঙ্গুর চিকিৎসায় এই ফল খুবই কার্যকর। আমাদের অনেক রোগী সুফল পেয়েছেন। তাছাড়া এই ফলে থাকা আয়রন রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। লোহিত রক্তকণিকা উৎপাদনে সহায়তা করে। তাই অ্যানিমিয়া রোগীদের জন্য ভাল।
ড্রাগন ফলের বাইরের খোসা দেখতে রূপকথার ড্রাগনের পিঠের মতো। রূপকথার ড্রাগনের মতো কিছুটা মিল থাকার জন্য ড্রাগন ফল হিসেবে পরিচিত। ড্রাগন ফলের আদি বাড়ি মেক্সিকো, দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকায়। কিন্তু পরবর্তীকালে কম্বোডিয়া, থাইল্যাল্ড, ফিলিপিন্সেও চাষ শুরু হয় এই ফলের। এখন বাংলাদেশের নাটোর, পাবনা, বগুড়া, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় প্রচুর ফলন হচ্ছে।
ড্রাগন এক ধরনের ফনীমনসা বা ক্যাকটাস প্রজাতির ফল। ড্রাগন ফলের বৈজ্ঞানিক নাম হাইলোসেরিয়াস আনডেটাস। ড্রাগন ফল দেখতে সুন্দর, সুস্বাদু ও আকর্ষণীয়। ফলের ভেতর কালোজিরার মতো ছোট ছোট বীজ থাকে। আমাদের দেশে যে সমস্ত বিদেশী ফলগুলো চাষ করা হয় তার মধ্যে ড্রাগন ফল অন্যতম। ড্রাগন ফল উজ্জ্বল গোলাপি বা লাল রঙের এবং আকারে বেশ বড়। একটি গাছ থেকে ১ মণ ফল আহরণ সম্ভব এবং ২০ বছর যাবৎ ফল আহরণ করা যায়। ড্রাগন ফলটিকে দুই ভাগে কেটে খুব সহজেই চামচ দিয়ে ভেতরের শাঁস খাওয়া যায়। তাছাড়া মিল্কশেক, কিংবা স্মুদি তৈরি করেও ড্রাগন ফল উপভোগ করা যায়।
সাধারণত তিন জাতের ড্রাগন ফল পাওয়া যায়। যথা- ১. লাল ড্রাগন ফল। ২. কোস্টারিক ড্রাগন ফল। ৩. হলুদ ড্রাগন ফল। লাল ড্রাগন ফলের খোসা লাল হলেও শাঁস সাদা রঙের হয়। কোস্টারিক ড্রাগন ফলের খোসা ও শাঁস উভয়ই লাল রঙের এবং হলুদ ড্রাগন ফলের খোসা হলুদ হলেও ভেতরের আঁশটা সাদা রঙের হয়ে থাকে। বিভিন্ন রঙের মধ্যে গোলাপি বা লাল রঙের ড্রাগন ফল আমাদের দেশে বেশ কয়েক বছর ধরে চাষ করা হচ্ছে।
ড্রাগন ফলে রয়েছে ৮০ থেকে ৯০ গ্রাম পানি। এছাড়া রয়েছে প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ফসফরাস, নায়াসিন, ভিটামিন সি।
ড্রাগন ফল হলো প্রয়োজনীয় ভিটামিন এবং খনিজ সমৃদ্ধ একটি ফল। এর ক্যালরি মাত্রাও তুলনামূলক অনেকটাই কম। এতে যথেষ্ট পরিমাণে ডায়েটরি ফাইবার রয়েছে। এক কাপ (২২৭ গ্রাম) ড্রাগন ফলে, ক্যালোরির মাত্রা ১৩৬, প্রোটিনের মাত্রা ৩ গ্রাম, ফ্যাটের মাত্রা শূন্য, ফাইবারের মাত্রা ৭ গ্রাম, আয়রনের মাত্রা ৮ শতাংশ, ম্যাগনেসিয়ামের মাত্রা ১৮ শতাংশ, ভিটামিন-সি এর মাত্রা ৯ শতাংশ, ভিটামিন-ই এর মাত্রা ৪ শতাংশ।
ড্রাগন ফলে ফ্ল্যাভোনয়েড, ফেনোলিক অ্যাসিড এবং বিটাসায়ানিন-এর মতো অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে সমৃদ্ধ। এগুলো কোষগুলোকে ফ্রি র্যাডিক্যালের হাত থেকে রক্ষা করে।
ড্রাগন ফলের অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে। জানা যাক সেগুলি কী কী-
ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়
ড্রাগন ফল কোলন ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে অত্যন্ত সহায়ক। তাছাড়া এ ফল ভিটামিন সি সমৃদ্ধ, তাই শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে তুলতেও সহায়তা করে। এটি বিভিন্ন দীর্ঘস্থায়ী রোগ যেমন ক্যানসার, ডায়াবেটিস, অ্যালজাইমার এবং পারকিনসন-এর মতো রোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে।
ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়
ফাইবার সমৃদ্ধ হওয়ায় রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে। ড্রাগন ফলের নিয়মিত সেবন, রক্তে শর্করার ভারসাম্যতা বজায় থাকে।
চোখের ক্ষেত্রে উপকারী
ড্রাগন ফলে বিটা-ক্যারোটিন রয়েছে। এই ফল চোখের বিভিন্ন সমস্যা যেমন- ছানি পড়ে যাওয়া এবং ম্যাকুলার ডিজেনারেশন প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে।
হার্টের জন্য উপকারী
ড্রাগন ফলের বীজ হার্টের জন্য উপকারী ওমেগা ৩ ও ওমেগা ৯ ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে। এই ফল খেলে হার্টের রোগের ঝুঁকি ও জয়েন্টের ব্যথা কমে যায়। এটি হার্ট ভালো রাখার পাশাপাশি রক্তচাপ ও ওজন নিয়ন্ত্রণেও সহায়তা করে।
বার্ধক্যের লক্ষণ প্রতিরোধ করে
অস্বাস্থ্যকর জীবনধারা, চাপ, দূষণ এবং খারাপ খাদ্যাভ্যাসের কারণে অকাল বার্ধক্যের সমস্যা আজ খুব সাধারণ ব্যাপার। ড্রাগন ফল ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ হওয়ায়, এটি ত্বককে উজ্জ্বল করে তুলতে সহায়তা করে। তাই ত্বকের উজ্জ্বলতা ধরে রাখতে দিনে একবার এর জুস খেতেই পারেন।
হজমের জন্য ভালো
ড্রাগন ফলে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে। ফলটি অনেকটা পিচ্ছিলজাতীয়। তাই এটি হজমে অনেক ভালো।
হাড়ের জন্য ভালো
অধিকাংশ ফলের চেয়ে ড্রাগন ফলে ম্যাগনেসিয়াম বেশি থাকে। এই ফলে প্রায় ১৮ শতাংশ ম্যাগনেসিয়াম বিদ্যমান, যা হাড়কে শক্তিশালী করে তোলে এবং হাড়ের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। ফলে জয়েন্টের ব্যথা, ফ্র্যাকচার কিংবা ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকিও অনেকটাই কমে যায়।
চুল পড়া আটকায়
আয়রন ঘাটতির কারণে চুল পড়ার সমস্যা দেখা দিতে পারে। নিয়মিত ড্রাগন ফল খেলে চুল পড়া কমতে পারে। এই ফল আয়রন ঘাটতিজনিত রক্তস্বল্পতার অন্যান্য উপসর্গও প্রশমিত করতে পারে, যেমন – অত্যধিক ক্লান্তি, ত্বকের বিবর্ণতা, মনোনিবেশে সমস্যা, মাথাব্যথা ও হাত-পায়ে ঠান্ডা অনুভূতি।
গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে উপকারিতা
এতে ভিটামিন বি, ফোলেট এবং আয়রন রয়েছে, তাই এটি গর্ভবতী নারীদের জন্য আদর্শ ফল। ভিটামিন বি এবং ফোলেট জন্মগত ত্রুটি রোধ করতে সহায়তা করে এবং গর্ভাবস্থায় শক্তি সরবরাহ করে। তাছাড়া এতে থাকা ক্যালসিয়াম ভ্রুণের হাড়ের বিকাশের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এতে ম্যাগনেসিয়ামও রয়েছে, যা নারীদের পোস্টমেনোপজাল জটিলতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করে।
ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
ড্রাগন ফল ভিটামিন সি দ্বারা সমৃদ্ধ। এই ফলটি আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জোরদার করতে পারে। এটি ওজন বজায় রাখতে বা হ্রাস করতেও সহায়তা করতে পারে। কারণ ৮০ শতাংশই পানি। ড্রাগন এমন একটি ফল যা প্রচুর পরিমাণে ফাইবার সমৃদ্ধ, যা নিশ্চিতভাবে আপনার অন্ত্রের গতিবিধিকেও নিয়ন্ত্রণ করবে।